ঐ সন্ধায় মৃদু বৃষ্টি হচ্ছিল। হক সাহেব পরিবারের সবাইকে নিয়ে প্রতিদিনের মত কাঁঠাল আর মুড়ি খাচ্ছিলেন। হঠাৎ বাইরে থেকে কিছু যুবক এসে খবর দিলো, গ্রামে মিলিটারি আসছে। কেউ যেন বাসা থেকে বের না হয়। হক সাহেব তার খাওয়া শেষ না করেই সেই যুবকদের সাথে বেরিয়ে পড়লো।
________
রাত তখন অনেক হবে, গভীর রাত। হক সাহেব বাসায় ফিরে তড়িঘড়ি করে জমানো কিছু টাকা সঙ্গে নিলেন। স্ত্রীকে তেমন কিছুই বললেন না। সকাল বেলা শোনা গেলো পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্প দূরবর্তী গ্রামের একটি প্রাইমারী স্কুলে। কিন্তু সবাই পেরেশান, হক সাহেব আর তার বন্ধুরা এখনও বাড়ী ফেরেনি।
_________
একরাত না পেরোতেই সেনা ক্যাম্পে হামলা। হানাদার বাহিনীর অপারেশন শুরু মুক্তিবাহিনী খোঁজের জন্য। যে বাড়িতে পুরুষ পাওয়া গেছে তাদের ধরে নিয়ে গেলো আর যাদের বাড়িতে পুরুষ নেই তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হলো।
হক সাহেবের শখের দোতলা কাঠের বাড়ীটিও বাদ যায়নি। পিতলের থালা, গহনা সব মিলিটারি অফিসারের গাড়িতে তোলা হয়েছে। পরনের কাপড় ছাড়া অবশিষ্ট কিছুই নেই। ৬ ছেলে মেয়ে সবাইকে লাইনে দাঁড় করানো হয়েছে ব্রাশ ফায়ারের জন্য। হক সাহেবের স্ত্রী পায়ে পড়লেন হানাদার বাহিনীর অফিসারের। এই যাত্রায় সবাই বেঁচে যায় ঠিকই কিন্তু নিঃস্ব হয়ে পড়ে হক সাহেবের পরিবারটি।
_________
হক সাহেব ও তার বন্ধুদের কোন খোঁজ-খবর নাই। মাস চারেক পর তার বন্ধুরা ফিরতে পারলেও হক সাহেব ফেরেন নি। পরে শোনা যায়, ভারত থেকে অস্ত্র আর গোলাবারুদ আনার জন্য যে টিম পাঠানো হয়েছিলো তার মধ্যে হক সাহেবও ছিলো। ল্যান্ড মাইন আর গ্রেনেড লুঙ্গীর মধ্যে বাঁধা ছিল। চেক পয়েন্টে আসার আগে কমান্ডার সাথীদের বলে রেখেছিলো, কোন ঝামেলা হলে সবাই যেন দ্রুত সরে যায়। চেক পয়েন্টে আসার পর সেনাদের সন্দেহ হয়। পেছন থেকে গুলি করে সেনারা। সাথে থাকা গ্রেনেড ২-৩টা ছোড়ার পর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন হক সাহেব। জীবনের মায়া ত্যাগ করে কমান্ডার আর সঙ্গীদের নিরাপদে সরিয়ে দেন।
__________
ছবির মানুষটি আমার পরম শ্রদ্ধেয় শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল হক হাওলাদার।
গ্রামের পোস্ট-মাস্টার হিসেবে যোগদান করে নিজের কর্মজীবন শুরু করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর "সৈনিক" পদে যোগ দেন।
________
দাদা মারা যাওয়ার কথা দাদী বিশ্বাস হয়নি। তার বিশ্বাস ছিলো হক সাহেব ফিরবেই, অন্তত তার ছেলেমেয়েদের জন্য হলেও। ছোট ফুফুর বয়স ছিলো তখন ৩ মাস। আমার আব্বার (মেঝো) বয়স তখন ৭-৮ বছর।
আমাদের হাওলাদার পরিবারে মোট ৩জন মুক্তিযোদ্ধা আমার দাদা আর আমার বড় দাদা ২ ছেলে (আমার চাচা)।
আমি গর্বিত একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার দৌহিত্র হিসেবে। গর্বিত আমার শ্রদ্ধেয় দাদার জন্য, দুই চাচার জন্য। আমি গর্বিত কারণ আমি বাংলাদেশি।